পাপের
রাজ্য
মানুষ স্বভাবতই পাপপ্রবণ; পাপের মোহন মায়া তাহাকে
অতি সহজেই আকর্ষণ করে। যখন আদিম মানুষ সকল ব্যথা-বেদনার উর্দ্ধে, সমস্ত দুঃখ-ক্লেশের
অতীতে আল্লার অনন্ত করুণার সৃষ্টি—নিঃসীম শান্তির নিলয় স্বর্গরাজ্যে বিচরণ করিত, তখনও
পাপের আহ্বান তাহার কাছে আসিয়াছিল। সেদিন সে এক অনাস্বাদিত সুখের প্রলোভনে মজিয়া আপনাকে
কালিমালিপ্ত করিয়াছিল। অনন্ত আলোকের দেশ ছাড়িয়া সে এই দুনিয়ার শত দুঃখের কণ্টকবনে অশ্রুজলে
নামিয়া আসিয়াছিল। সেই অশুভ মুহূর্ত্ত হইতে মলিনতার দিকে মানুষের বিরামহীন প্রবৃত্তি,
পঙ্কিল পথের দিকে তাহার অবিশ্রান্ত গতি।
কিন্তু মানুষের যিনি স্রষ্টা, সৃষ্টির মহান উদ্দেশ্যকে
তিনি ব্যর্থ হইতে দেন নাই। জগতে যখনই নীতি ও ধর্ম্মের গ্লানি ঘটিয়াছে, দুর্নীতি ও অধর্ম্ম
মানুষের পাপ-প্রবৃত্তির আশ্রয়ে লালিত ও পুষ্ট হইয়া তাহাকে গ্রাস করিতে চাহিয়াছে, তখনই
আল্লার অন্তহীন প্রেম-করুণার মূর্ত্তিমান প্রতীকরূপে আলোকের প্রদীপ হাতে লইয়া মহামানুষেরা
আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন। শত দুঃখ-লাঞ্ছনা সহিয়া—লৌহের মতো কঠিন, পাহাড়ের মতো দুর্লঙ্ঘ
বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করিয়া তাহারা দৃষ্টিহারা মানুষের জন্য পথ কাটিয়া চলিয়াছেন। কণ্টকের
ঘায়ে চরণ তাহাদের ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে, অস্ত্রের আঘাতে দেহ তাহাদের জর্জ্জরিত হইয়াছে,
ঝঞ্ঝার দাপটে অঙ্গের বসন তাহাদের ছিন্নভিন্ন হইয়াছে, কিন্তু হাতের বাতি তাহাদের নিভিয়া
যায় নাই; উর্দ্ধদেশ হইতে যে আলোকধারা নামিয়া আসিয়া তাহাদের অন্তরগুলিকে চির-উজ্জ্বল
করিয়া রাখিয়াছে, এক মুহূর্ত্তের জন্যও তাহা পরিম্লান হয় নাই।
জগতের এই সব মহামানুষেরাই নবী, রসুল বা পয়গম্বর।
স্বর্গের শুভ সন্দেশ বহন করিয়া তাহারা মানবসমাজে আবির্ভূত হইয়াছেন। পাপ-তাপের দহনে
মানুষ জীবন্মৃত হইয়া পড়িয়াছে; তাহারা আসিয়া তাহাকে জীবনের কল্যাণ-বাণী শুনাইয়াছেন।
রঙিন মোহের আকর্ষণে চিরসুন্দরের পথ ছাড়িয়া মানুষ আবিলতার পঙ্কে নিমজ্জিত হইয়াছে; তাহারা
নিজেদের মঙ্গল-হস্ত প্রসারিত করিয়া তাহাকে মুক্তির দিকে আকর্ষণ করিয়াছেন। আত্মাকে ভুলিয়া
ভ্রান্তি ও বিস্মৃতির ঘোরে মানুষ আপনার ভাগ্যে শত নিগ্রহ সহস্র দুর্ভোগ ডাকিয়া আনিয়াছে;
তাহারা নন্দন বনের মধু বিলাইয়া তাহাকে সান্ত্বনা দিয়াছেন। আপনার আবাস ছাড়িয়া মানুষ
শত লাঞ্ছনা ও অপমানে ধূলায় অবলুণ্ঠিত হইয়াছে; তাহারা প্রেম ও পুণ্যের অভিসিঞ্চনে তাহাকে
পুনরুজ্জীবিত করিয়াছেন।
তথাপি পাপের দিকে মানুষের অন্তহীন প্রবণতা, কলুষিত
জীবনের দিকে তাহার অবিশ্রান্ত প্রবৃত্তি। এইজন্যই নবী, রসুল ও পয়গম্বরদের নিবেদিত জীবনের
শত প্রয়াসকে তুচ্ছ করিয়া যুগে যুগে তাহার পতন যেন অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু
নিঃসীম করুণার পারাবার— রহমানুর রাহিম আল্লার যেন ইচ্ছা নয়, যে পাতিত্য ও ভ্রষ্টতার
পঙ্কিল পথে মানুষের অবিরাম গতি হোক। তাই নীতি ও ধর্ম্মকে তাহার জীবনকর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত
করিবার জন্য অধর্ম্ম ও অনাচারের প্রলোভন হইতে রক্ষা করিয়া তাহাকে সৎ ও মহৎ করিয়া তুলিবার
জন্য যুগে যুগে মহামানুষেরা উর্দ্ধলোকের আহ্বান লইয়া জন-সমাজে অবতীর্ণ হইয়াছেন।
হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (তাঁহার উপর আল্লার আশীর্বাদ
ও শান্তি বর্ষিত হোক!) এই শ্রেণীর একজন মহামানুষ। মরুভূমির দেশ— আরবে তিনি জন্মগ্রহণ
করেন। তাঁহার পূর্বে অধঃপতিত মানুষকে মুক্তি-সাধনার পথ দেখাইবার জন্য জগতের বিভিন্ন
দেশে, বিভিন্ন যুগে শত শত নবী ও রসুল আলোকময় জীবনের আহ্বান লইয়া আসিয়াছিলেন। কিন্তু
মানুষ চিরদিন তাহাদের মতানুসরণ করে নাই। পাপের প্ররোচনায় সে তাঁহাদের প্রদর্শিত পথ
পরিত্যাগ করিয়া দুর্নীতিকণ্টকিত, শত কলুষকলঙ্কিত জীবনকে সাগ্রহে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়াছে।
যে পূত পবিত্র-শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত আত্মাকে মানবসমাজে চিরঞ্জীব করিবার জন্য তাঁহারা
জগতের মঙ্গল-প্রয়াসে আপনাদের বিলাইয়া দিয়াছিলেন, মানুষ তাহাকে বিভ্রম ও বিলাসের প্রবঞ্চনায়
পদে পদে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করিয়াছে।
পবিত্র জীবনের এই অপমান ও লাঞ্ছনা ঘুচাইয়া তাহাকে
সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য হজরত মোহাম্মদ আসিলেন। তাঁহার আবির্ভাবের প্রাক্কালে ধর্ম্ম
ও নীতির দিক দিয়া সেই যুগের সভ্যজগতের অবস্থা সত্যই অতি শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছিল। এশিয়া,
আফ্রিকা, ইউরোপ— সকল মহাদেশেই পাপের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী,
খৃষ্টান— সকল ধর্ম্ম-সম্প্রদায়ই প্রাচীন গ্রন্থসমূহের শিক্ষানীতি ছাড়িয়া দুর্নীতি ও
অনাচারের পথে বহুদূর চলিয়া গিয়াছিলেন।
ভারতবর্ষ প্রাচীন সুসভ্য দেশ। কিন্তু এই সময় ভারতীয়েরা
ঐশী বাণীর মর্য্যাদা ভুলিয়া সম্পূর্ণরূপে মোহাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। এক অদ্বিতীয়
নিরাকার ব্রহ্মের
উপাসনা ত্যাগ করিয়া তাঁহারা অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্ত্তিপূজায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাঁহারা
একদিকে উদার সাম্যনীতির আশ্রয়ে লালিত মহান মানবতার মূল্য নিরূপণ করিতে না পারিয়া তাহার
জন্য দেবতার বেদী রচনা করিয়াছিলেন; অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘৃণায়, অবহেলায় পতিত শূদ্র
ভাবিয়া তাহাকে মনুষ্যত্বের তুচ্ছতম অধিকার হইতেও বঞ্চিত করিয়াছিলেন।
চীনের ধর্ম্মীয় জীবনেও এই যুগে চরম অধঃপতন দেখা
দিয়াছিল। কংফুচ এবং তাঁহার পরবর্ত্তী গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা বিস্মৃত হইয়া চীনবাসীরা শুধু
নানারূপ দেবদেবীর কল্পনা করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, দেশের রাজাকেও পুরুষানুক্রমে সর্ব্বশক্তিমান
আল্লার আসনে বসাইয়া তাঁহার পূজায় লিপ্ত হইয়াছিলেন। প্রতিমাপূজা মানবপূজার নিত্যসহচর
যে-সব নৈতিক ও সামাজিক দুর্নীতি, সেগুলিও তাঁহাদের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল।
সুসভ্য ইরানের অবস্থাও এ যুগে অত্যন্ত শোচনীয় হইয়া
দাঁড়াইয়াছিল। এখানকার অধিবাসীরা নিরাকার বিশ্বস্রষ্টাকে ছাড়িয়া অগ্নিপূজা, গ্রহপূজা
প্রভৃতিকে নিজেদের আত্মিক জীবনের প্রধান সম্বল করিয়াছিলেন। ইহার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদের
সমাজের নৈতিক ভিত্তিও একেবারে ধসিয়া পড়িয়াছিল। পশুপ্রকৃতির প্ররোচনায় তাঁহারা হীনতম
প্রবৃত্তিপূজাকে ধর্ম্মানুষ্ঠান কল্পনা করিতে শিখিয়াছিলেন।
“ ” - Robi User
“ ” - jahid islam
“ ” - Nila Akter
“ফাহাদ ” - Robi User