আদি যুগ
১
‘চট্টগ্রাম’ নামের উৎপত্তি
তিব্বতী সূত্রে১
চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম পাওয়া যাচ্ছে—‘জ্বালনধারা’—তপ্তজল সমন্বিত অঞ্চল। এখানে কিছুকাল
বাস করেছিলেন বলে সিন্ধুদেশীয় বৌদ্ধ সিদ্ধ বালপাদ জ্বালন্ধরী নাম প্রাপ্ত হন। এরই অপর
নাম হাড়িফা। ঝাড়ুদার হাড়ির কাজ করেছিলেন বলেই এই নাম। হয়তো অগ্নিতপ্ত জল ধারণ করে বলেই
স্থানটি ‘জ্বালন্ধর’ নামে পরিচিত ছিল। সীতাকুণ্ডে ও বাড়বকুণ্ডে এখনো তপ্তজল পর্বতগাত্র
থেকে নিঃসৃত হয়। এরই আরবি-ফারসি নাম সম্ভবত ‘সামন্দর’। সাম—(অগ্নি) অন্দরে (অন্তর<অন্দর)
আছে যে স্থানে সেটিই সামন্দর।২
সামন্দর নামের প্রথম
উল্লেখ পাই, ইবন খুর্দাদবেহ-র বর্ণনায়। ইনি এ অঞ্চলকে ‘রুহম’ বা ‘রুহমি’ রাজার শাসনভুক্ত
বলে উল্লেখ করেছেন। সামন্দরের দ্বিতীয় উল্লেখ মেলে ‘হুদুদুল আলম’ গ্রন্থে। এখানে রাজার
নাম ‘দহুম’। এই দহুম ও রুহুম—ডক্টর আহমদ হাসান দানীর মতে, একই নামের বিকৃতি। দহুম>দহম>দহ্ম>ধর্ম।
ইনি বঙ্গাধিপ ধর্মপাল।৩ হোদীওয়ালাও এ মত পোষণ করেন।৪ আর এক কিংবদন্তি
এই যে, আরাকানরাজ চূড়সিংহ চন্দ্র (Chulataing
Tsandaya) ৯৫৩ খ্রীস্টাব্দ চট্টগ্রাম জয় করে সেখানে একটি
জয়স্তম্ভ নির্মাণ করান এবং তাতে Tsit-Tat-Gung—‘যুদ্ধ
করা অনুচিত’—এই বাণী উৎকীর্ণ হয়। এরই বিকৃত রূপ 'চাটিগাঁও'। চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মতে
‘চৈত্যগ্রাম’ থেকে চাটিগ্রাম বা চট্টগ্রাম-এর উৎপত্তি। হিন্দুদের ধারণা ‘চট্ট’ (কুলীন
ব্রাহ্মণ)-দের নিবাস বলে চট্টল>চট্টলা, কিংবা চট্টগ্রাম হয়েছে। মুসলমানদের বিশ্বাস,
শাহ বদর আলম চাটি (মৃৎবর্তিকা) জ্বালিয়ে জ্বীন-পরীর কবল থেকে অঞ্চলটিকে মুক্ত করেন
বলে, স্থানটি চাটিগ্রাম বা চাটিগাঁও নামে অভিহিত হয়েছে। Bernonilli বলেছেন—আরবি শাত (বদ্বীপ) ও গঙ্গা
(নদী) থেকে, অর্থাৎ গঙ্গার মুখস্থিত বদ্বীপ অর্থে আরব বণিকেরা একে ‘শাৎগাঁঙ’>শাৎগাঁও
নামে অভিহিত করত৫ এবং উচ্চারণ বিকৃতির ফলে চাটর্গাও চাটিগাঁও, এবং সংস্কৃতায়নের
ফলে চট্টগ্রাম হয়েছে বলে অনুমিত। District
Gazetteer : Chittagong-এ O’ Malley অনুমান করেছেন, সংস্কৃত 'চর্তুগ্রাম'
বা চারিগ্রাম থেকে 'চাটিগাঁও' নামের উৎপত্তি। 'আহাদিসুল খাওয়ানীন' লেখক খান বাহাদুর
হামিদুল্লাহ খানের মতে হোসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রী.) পুত্র নুসরৎ শাহ ১৫১৩ খ্রীস্টাব্দে
চট্টগ্রাম জয় করে এর নাম দেন ‘ফত্হ-ই-আবাদ। এবং শায়েস্তাখান ১৬৬৬ সনে চট্টগ্রাম অধিকার
করে আওরঙজেবের অভিপ্রায়ক্রমে এর নাম রাখেন ‘ইসলামাবাদ’। পর্তুগীজ বণিকেরা Porte grando বলেই এর পরিচয় দিত। আল্ ইদ্রিসী
কর্ণফুলীর নামানুসারে একে ‘কর্ণবুল’ নামে আখ্যাত করেন।
২
দেশ-পরিচয়
প্রাচীনকাল থেকেই সামুদ্রিক
বন্দর বলে চট্টগ্রামের ইতিহাস ঋজু থাকেনি। রক্তে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাও দেশবাসীর
পক্ষে তাই সম্ভব হয়নি। নানা জাতির সংমিশ্রণে সঙ্কর সমাজের উদ্ভব যে গোড়া থেকে হয়েছিল,
তা সহজেই অনুমান সম্ভব। এমনি সঙ্কর সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনও বৈচিত্র্যে জটিল হয়ে উঠে।
ইতিহাসবিহীন প্রাচীন যুগের কোনো সংবাদ আমাদের কালে এসে পৌঁছেনি। তবে পরোক্ষ তথ্যের
আলোকে একটি কল্পচিত্র আঁকা যায়।
ঋগ্বেদের আমলে আজকের
বাঙলা দেশের অধিকাংশ ছিল সমুদ্র। আরো অনেক পরে শুক্লযজুর্বেদের যুগেও গণ্ডকী নদীর পূর্বদিক
ছিল জলপ্লাবিত। মহাভারতিক কালেও দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ ছিল সমুদ্রে লীন। পর্যটক স্ট্রাবোর
ভারত ভ্রমণ কালে (১৮-২৪ খ্রী.) সমুদ্রের লোনাজল প্রতিরোধের জন্যে বহু নগরের চারদিকে
বাঁধ ছিল। হিউএয়নৎ সাঙও সমতট কামরূপের মধ্যাঞ্চলে প্রায় হাজার ক্রোশব্যাপী হ্রদ প্রত্যক্ষ
করেছিলেন।
তবু বাঙলা ও আসাম যে
মহাভারতিক যুগে বসতিবহুল ছিল তা নিশ্চিত। পুণ্ড্রের বসুদেব, ভগদত্তের প্রাগজ্যোতিষপুর
(আসাম)৬ ঐ যুগের আর্যদের অজ্ঞাত ছিল না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (খ্রী. পূ. ৭ম
শতক) পুণ্ড্রের জনগণকে দস্যু বলা হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যকে অনার্য বঙ্গ, বগধ (মগধ) ও চের
জাতির উল্লেখ রয়েছে।৭ এতে অন্তত একটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যে খ্রীস্টপূর্ব
সাত শতকেও এদেশে জনবসতি ছিল এবং তাদের সম্বন্ধে কিছু সংবাদ আর্যসমাজে আহৃত হয়েছে।
বৌধায়নসূত্রে অঙ্গ ও
মগধের লোকেরা অভিহিত হয়েছে ‘সংকীর্ণযোনি’ (তথা অংশত আর্য বা আর্যরক্ত সম্পৃক্ত) বলে।
আর কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও বঙ্গদেশকে তখনো আর্য-বর্জিত অঞ্চল বলে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এদেশে
আসলে ফিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। এর পরে রচিত একটি শ্লোকে৮ দেখতে পাই
তীর্থদর্শনার্থ অঙ্গে, বঙ্গে ও কলিঙ্গে যাওয়ার বিধান রয়েছে। এতে বোঝা যায়, সমাজক্ষেত্রে
উক্ত অঞ্চলত্রয়ের লোক ঘৃণ্য হলেও তাদের দেশের স্থানবিশেষ তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা লাভ
করেছে। এর মধ্যে বাঙলায় আর্য আর আর্যধর্ম ও সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের প্রমাণ, অন্তত আভাস
মেলে। সম্ভবত বাঙলার গঙ্গাসাগর ও উড়িষ্যার বৈতরণী তীরই এই অনুক্ত তীর্থক্ষেত্র।৯
দুটো লিপির সাক্ষ্যেও
প্রমাণিত হয় যে খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এদেশে আর্য-প্রভাব দৃঢ় ও গাঢ় হয়ে উঠেছে। এর
একটি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের এবং মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত১০ এবং অপরটি খ্রীস্টপূর্ব
দ্বিতীয় শতকের, প্রাপ্তিস্থান নোয়াখালির মিলুয়া গাঁ।১১ এছাড়া বাঙলার বিভিন্নস্থানে
প্রাপ্ত কুষাণ আমলের মুদ্রাও আর্যাবর্ত তথা উত্তরভারতের সঙ্গে বাঙলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের
নিঃসংশয় প্রমাণবাহী।১২ এসব থেকে সহজেই অনুমান করা চলে আর্য ধর্ম, ভাষা ও
সংস্কৃতি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পূর্বেই বাঙলা দেশে চালু হয়েছে। আর্যবসতি না থাকলে এ কিছুতেই সম্ভব হত না।
সিংহলী মহাবংশ বর্ণিত কাহিনীসূত্রে জানা যায়—খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে
বঙ্গে রাজা ও রাজ্য ছিল।১৩ এতে বাঙলার বর্বরোত্তর যুগের আভাস পাই।
“ ” - Sanjoy Dey
“ ” - Suvashis Barua
“ ” - ?????????? ????????? ????????